তালিয়া

বাংলাদেশ কিসে চ্যাম্পিয়ন বলুনতো? ফুটবলে না, ক্রিকেটে না, বাস্কেটবল বা ভলিবল দুরে থাক, এমনকি হা-ডু-ডু তেও না৷ বিগত পাঁচ বছর ধরে আমরা এমন একটা বিষয়ে চ্যাম্পিয়ান হয়ে আসছি, যেটার কথা আমাদের শিশুরা কখনো তাদের সাধারণ জ্ঞান বইয়ে খুঁজে পাবে না৷ অ্যাল্,ছি ছি, শিশুদের এর মধ্যে টানা উচিত নয়, এটা একেবারে অ্যাডাল্ট ওনলি ব্যাপার৷

কষ্ট করে মাথা চুলকে আর নতুন কোন খেলার নাম বের করতে হবে না৷ এখানে কোনো রহস্য রোমাঞ্চ সিরিজের গোয়েন্দা গল্প লেখা হচ্ছেনা, তাই বলেই দেওয়া যাক, ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের দুর্নীতির ইন্ডেক্সে বাংলাদেশ এক নম্বরে! কানে কানে আরও বলি, ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের রিপোর্ট অনুযায়ী দূর্নীতিতে চ্যাম্পিয়ান হবার ক্ষেত্রে যাদের সবচে বেশি অবদান -- তাদের নাম হচ্ছে পুলিশ৷ আইনের রক্ষক যাদেরকে বলে৷ বেশ বুঝতে পারছি, আর কোথাও চ্যাম্পিয়ন না হতে পারার যাতনা যেন আমাদের সইতে না হয়, পুলিশ বাহিনী সে জন্যে দিনরাত বিস্তর খেটে রীতিমত প্রাণপাত করে দিচ্ছে ৷

আহা, এ হেন প্রচেষ্টার জন্যে তাদের সাধুবাদ জানাতেই হয়৷

বাচ্চালোগ, তালিয়া বাজাও!

------------------------------------------------------------------

গত সোমবার দুপুরে গুলশানের শ্যুটিং রেঞ্জে প্রাকটিস করছিলেন আমাদের জাতীয় শ্যুটার আসিফ হোসেন খান৷

এমনিতে শ্যুটি ংব্যাপারটা আমাদের গরীব দেশের মানুষদের খুব একটা প্রিয় খেলা নয়৷ কিন্তু আসিফ নিজে খুব জনপ্রিয়৷ বিশ্বমানের প্রতিযোগিতাগুলোর হিটেই বাদ পড়ে যাওয়াটা আমাদের কাছে ডাল-ভাতের মত ব্যাপার৷ এমনকি সাফ গেমসের মত ঘরের পাশের টুর্নামেন্টেও আমরা খেলোয়াড় পাঠিয়েই সন্তুষ্ট থাকি৷ কোন পদক আশা করি না কখনো, খেলে টেলে গায়ে খানিকটা ধূলো মেখে ঘরের ছেলে ঘরে ফিরে আসুক, এরকমই আমাদের চাওয়া৷

প্রায় নিয়মে পরিনত হয়ে যাওয় রুটিনটায় বাদ সাধলেন এই আসিফ৷ ২০০২ এর কমনওয়েলথ আর ২০০৪ এর সাফ গেমসে তিনি দু'দুটো সোনা বাগিয়ে নিয়ে এলেন৷ রীতিমতন তুলকালাম ব্যাপার৷ গরীবের ঘরে হাতির পা! দেশের মানুষ নিজেদের গায়ে চিমটি কেটে দেখল, ভুল করে দেশের ক্রীড়াংগনে কোথেকে একটা তারা এসে জুটেছে, যার কল্যাণে এ ধরনের গেমসে আমরা আর কিছুতে না হোক, শ্যুটিংএ একটা সোনা জেতার স্বপ্ন রাতের বদহজম না হওয়া ছাড়াও দেখতে পারি৷

তো যা বলছিলাম, সোমবার দুপুরে তিনি আরো কয়েকজন শ্যুটারের সাথে প্রাকটিস করছিলেন৷ সেখানকার মিলনায়তনেই চলছিল এশিয় মহিলা উদ্যোক্তাদের ঈদ মেলা৷ মেলায় আসা অতিথিরা গাড়ি পার্ক করছিলেন রেঞ্জের সামনেই৷ কিন্তু একটা গাড়ি পার্কিংএর জায়গা বাদ দিয়ে এসে পার্ক করল ঠিক গেটের সামনে৷

একেবারে যেন অ্যাকশান সিনেমার ক্লাইম্যাক্স! পাঠক কি ভাবছেন? এটা নিশ্চয় কোন মন্ত্রীর গাড়ি৷ না, হলো না৷ তাহলে? কোনো সচিব, কিংবা আমলা? অথবা, নিদেনপক্ষে গোয়েন্দা কিংবা পুলিশ বাহিনীর প্রধানের গাড়ি?

তাও হলো না৷ ওটা ছিল পুলিশের ডিআইজির স্ত্রীর গাড়ি৷

হু হু বাবা,বাঘে ছুঁলে আঠার, পুলিশে ছুঁলে ছত্রিশ ঘা, আর পুলিশের বউ ছুঁলে? ক্যালকুলেটর লাগবে মশাই, দু হাতের আঙুলে হবে না!

আবারো, যা বলছিলাম৷ গাড়ি ওখানে রাখায় রেঞ্জের দারোয়ান বললেন গাড়ি সরিয়ে নিতে৷ কিন্তু পুলিশের-স্ত্রীর-গাড়ির-ড্রাইভার! তার একটা প্রেস্টিজ আছে না? ড্রাইভার জানালেন, এই গাড়ির-মালিকের-স্বাআমীর-পদবী হলো ডিআইজি৷ সুতরা গাড়ি সরবে না৷

লেগে গেলো কথা কাটাকাটি৷ ড্রাইভার সাহেব হাত চালিয়ে বসলেন৷ সুতরা ংকথা কাটাকাটি অচিরেই বদলে গেল হাতাহাতিতে৷ পাশ দিয়েই নাকি টহলরত পুলিশের দল হাওয়া খেয়ে বেড়াচ্ছিলেন৷ গন্ডগোল দেখে তারাও এসে হাত লাগালেন৷ খালি হাতে কি আর তাদের মানায়? সেই হাতে লাঠিও ছিল৷

এদিকে গোলমাল শুনে রেঞ্জের ভেতর থেকে শ্যুটাররা দেখতে এলেন কি হলো৷ আসিফও ছিলেন সেই দলে৷ পুলিশের সাথে মারামারি দেখে তারা সেটা থামানোর চেষ্টা করলেন৷ কিন্তু পুলিশ তখন দারুন ফর্মে৷ তারা সামনে যাদের পাচ্ছে তাদেরই পেটাচ্ছে৷ শ্যুটারদেরও মেরে বসলো৷ মাটিতে ফেলে মার৷ কয়েকজন দৌড়ে দোতলায় গিয়েও নিস্তার পেলেন না, সেখান পর্যন্ত ধাওয়া করে গিয়ে মেরে আসা হলো সবাইকে৷

যাবার সময় আসিফ সহ আরো পাঁচজনকে থানায় নিয়ে যাওয়া হলো৷ সেখানে গিয়ে আরেকদফা মার৷ হাতে, পায়ে, পায়ের তলায় লাঠি দিয়ে অমানুষিক মার৷ লাঠি ভেঙ্গে গেলে হকিষ্টিক দিয়ে শুরু হলো৷

এর মাঝে আসিফ কয়েকবার নিজের নাম ও পরিচয় বললেন৷ তার উত্তরে তাকে বলা হলো, "রাখ তোর শ্যুটার!'

বাহ বাহ, একদম চ্যাম্পিয়ানের মত কথা! ওনারা বছর বছর দেশকে চ্যাম্পিয়ান বানাচ্ছেন, তাদের কাছে আসিফ কোন ছার!

শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত, আসিফ মোটামুটি চলত্শক্তিহীন৷ বাম হাতে কোন শক্তি পাচ্ছেন না৷ ডান হাতও তথৈবচ৷ আর কোনোদিন রাইফেল হাতে নিতে পারবেন কিনা বলা যাচ্ছে না৷ যদিও এর মাঝেই তিনি হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে অভিমান নিয়ে ঘোষনা দিয়েছেন, তিনি শ্যুটি ংছেড়েই দেবেন৷
-------------------------------------------------------------------

পত্রিকার পাতা খুললেই শুধু পুলিশি কীর্তির খবর পাই৷ কদিন আগে প্রাক্তন স্বরাষ্ট মন্ত্রীকে রাস্তায় ফেলে পিটিয়েছিল তারা, সে ছবি পত্রিকায় দেখে শিউরে উঠতে হয়৷ তারো কিছুদিন আগে চট্টগ্রামে পিটিয়েছিল সাংবাদিক৷ কয়েকদিন আগে দেখলাম হরতালরত বিরোধীদলীয় নারী কর্মীদের পরনের জামা ছিড়ে ফেলতেও তাদের একটুও হাত কাঁপেনি৷

নাহ, এসবে কোন সমস্যা নেই আমাদের৷ বিরোধীদলীয় নারীকর্মী, ফটো সাংবাদিক কিংবা প্রাক্তন স্বরাষ্টমন্ত্রী, এঁরা কেউই আমাদের খুব একটা উপকারে আসবেন না৷ কাজে আসবেন না আসিফও৷ একটা দুটো সোনা দিয়ে কিই বা হবে আমাদের? ডিআইজির বউএর কানের দুলেও তার চেয়ে বেশি পরিমান সোনা থাকে৷

সুতরাং পিটিয়ে সবার হাতপা ভেঙ্গে দিন, দেশ ছাড়া করুন, কোন অসুবিধা নেই৷

শুধু ভাবি, পুলিশের দায়িত্বে থাকা বর্তমান স্বরাষ্টমন্ত্রী কি একবারো ভেবে দেখেছেন, প্রতি পাঁচবছর পর সবার পেছনেই "প্রাক্তন' শব্দটি যোগ হবার একটা প্রবল সম্ভাবনা থাকে? তিনি নিজে যখন 'প্রাক্তন' হবেন তখন এই ফ্রাংকেনস্টাইনের হাত থেকে তিনি নিজেকে বাঁচাতে পারবেন তো?

বাচ্চালোগ, তালিয়া থামাও৷ এর চেয়ে বরং বসে বসে নামতা পড়ো, পাঁচ-এক্কে-পাঁচ৷

*****************

প্রথম প্রকাশঃ কুটকচা৯ - গুরুচন্ডালি


Popular posts from this blog

The Boy, the Mole, the Fox and the Horse | Charlie Mackesy

মধ্যাহ্নভোজ | উইলিয়াম সমারসেট মম্‌ | রূপান্তরঃ তারেক নূরুল হাসান

আরেকটিবার-