খাবি দাবি কলকলাবি

পেট দেখে ইদানীং আমাকে পেটুক বলে চেনা গেলেও, ছেলেবেলায় কিন্তু আমি এরকম ছিলাম না। এরকম, মানে যে পেটুক ছিলাম না, ব্যাপারটা তা নয়। সেটা ছিলাম ঠিকই, তবে পেটের আকৃতি তখনো দ্রষ্টব্য কিছু হয়ে ওঠে নি আমার।

বাসায় আমার যন্ত্রণায় বিস্কুট চানাচুর ঠিক জায়গায় রাখবার উপায় ছিলো না। নানা জায়গায় লুকিয়ে রাখতে হতো। তবে কিছুতেই আমাকে দমিয়ে রাখা যেত না। আমি খুঁজে টুজে বের করে, তাদের সবচেয়ে সঠিক জায়গায়, মানে আমার পেটের ভেতরে নির্দ্বিধায় চালান করে দিতাম। মাঝে মাঝে দু'এক পদের বিস্কুট যদিওবা লুকিয়ে রাখতে পারতো, কিন্তু আমিও তক্কে তক্কে থাকতাম। মেহমান বাসায় এলেই আমি খুশিতে বাগডুম। এ বারতো লুকোনো বিস্কুট বের করতে হবেই! এবং তাই হতো। মেহমানদের দেবার জন্যে লুকোনো ভান্ডার থেকে বের করা হতো সেসব। আর আমি শুধু ঘড়ি দেখতাম কখন তারা বিদায় নেবে। এবং যখন সত্যিই ওরা চলে যেত, বিস্কুট চানাচুর আবারো লুকোবার আগেই আক্ষরিক অর্থেই ঝাপিয়ে পড়তাম সেসবের উপরে।

এই খাদ্যপ্রীতি যে কেবল নিজের বাসায় বলবৎ ছিলো তা নয়। পরিচিত আত্মীয়দের বাসায় যাবার ব্যাপারেও আমি বাছ-বিচার চালাতাম। কোন বাসায় গেলে কোন মানের বিস্কুট খেতে দিবে, মনে মনে সে বিষয়ে আমার জরিপ চালানো হয়ে গিয়েছিলো বহু আগেই। তাই বেড়াতে যাওয়ার কথা শুনলে আমি আগে সেটা মিলিয়ে নিতাম, পূর্ব ইতিহাস সন্তোষজনক হলেই কেবল 'যাবো' বলে মত দিতাম। নইলে, আমাকে ধরে বেঁধেও কেউ ওখানে নিয়ে যেতে পারতো না!

সেই সময় সুপার বিস্কুট নামের একপ্রকার বিস্কুটের খুব প্রচলন ছিলো। আকারে ছোট, গোল গোল, স্বাদে মাঝামাঝি, সর্বোপরি দাম কম এবং প্লেটে রাখলে একসাথে 'অনেক' বিস্কুটের একটা দৃষ্টিঘটিত আবেদন ছিল তার, কিন্তু আমার খেতে একদমই ভাল লাগতো না।
তো ঘটনা হচ্ছে, আমাদের আত্মীয় পরিধির একটা বাসায় এই বিস্কুটের খুব চল ছিলো। ছোট ছিলাম বিধায় নানুর সাথে তাঁর আঙুল ধরে আমাকে আত্মীয়দের বাসায় বিচরণ করতে হতো। নানা স্বাদের নানা বিস্কুটের অমোঘ আকর্ষণে আমার সেসব বাসায় যেতে খারাপ লাগতো না অবশ্যই। কিন্তু সেই সুপার বিস্কুট-অলা বাসার প্রতি আমার খানিকটা বিরাগ ছিলো। একদিন বা দুদিন নয়, এরকম বেশ কয়েকদিন হলো যে ওখানে গেলাম আর আমাকে খেতে দেয়া হলো সুপার বিস্কুট। আমি সেগুলোর ওপরে বিষদৃষ্টি নিক্ষেপ করে বসে থাকি। সেই আত্মীয়দের নিদারুন নির্মমতায় আমি অবাক আর পীড়িত হই, খানিকটা ভাল মানের বিস্কিটও এরা আনতে পারে না!

তেমনি একদিন, সেই সুপার বিস্কুট-অলা বাসায় অনেকক্ষণ কাটিয়ে দেবার পর, আমার মন ততক্ষণে তিতিবিরক্ত। বেশ কয়েকবার নানুর হাত ধরে ঝাঁকুনি দেয়ার পরে বিদায় নিবো যখন, তখন সে বাড়ির লোকজন বিদায় সম্ভাষন জানালো আমাদের। পিচ্চি ছিলাম বিধায়, কেউ একজন আমার থুতনিতে আদর করে বললো, আবার এসো আমাদের বাসায়।
এই কথা শুনে আমার মনের ভেতর জমা অভিমান খানিকটা উস্কে উঠলো। আমি কি ভেবে সরোষে বলে উঠলাম, নাহ, আপনাদের বাসায় আর আসবো না।
নানু অবাক। এবং ওই বাসার বাকি সবাইও। জিজ্ঞেস করলো, কেন কেন?
আমি তৎক্ষনাৎ বোম ফাটালাম, কেন আসবো? এলেই খালি সুপার বিস্কুট খেতে দ্যান! ভাল বিস্কুট দিতে পারেন না?

পরবর্তী সময়ে কি হয়েছিল জানি না। অপ্রস্তুত ভঙিতে খানিকটা হাসাহাসির কথা মনে পড়ে। কিন্তু আমার সেই অগ্নুৎপাত সেই বাড়ির বহুদিনের সুপার বিস্কুটীয় ঐতিহ্য ভাঙতে পেরেছিলো কিনা এতদিন পরে আজ আর সে কথা মনে নেই।

Popular posts from this blog

The Boy, the Mole, the Fox and the Horse | Charlie Mackesy

মধ্যাহ্নভোজ | উইলিয়াম সমারসেট মম্‌ | রূপান্তরঃ তারেক নূরুল হাসান

আরেকটিবার-