ইংরেজি মাধ্যম নিয়ে অল্প দু'চারটে কথা

সবজান্তার পোস্ট -একুশের কোপাকুপি- পড়ে অনেক পুরনো কথা মাথার ভেতরে ভীড় করে এলো।

ঢা-বির ছাত্র হবার পর পর মনের ভেতর বেশ জোশ নিয়ে ঘুরে বেড়াতাম। কার্জন হলে আমাদের ফিজিক্স ডিপার্টমেন্টের অফিসে নাম রেজিস্ট্রি করতে গিয়ে অফিসের ক্লার্ক যখন আবেদন পত্রটা আমার দিকে বাড়িয়ে ধরে বললেন, 'এইখানে একটা সাইন করেন।' আমি বেশ অনেকক্ষণ বুঝতেই পারি নি যে কথাটা আমাকে বলা হচ্ছে। এর আগে কে আমাকে সম্মান করে 'আপনি' সম্বোধন করেছিলো- অনেক ভেবেও মনে করতে পারলাম না।
তো, ঐ কাগজে স্বাক্ষর করতে করতেই বুঝলাম বড় হয়ে গেছি।

কিন্তু এই আনন্দদায়ক ব্যাপারটা একা বুঝলে তো চলবে না, বাসার লোকজনকেও জানান দিতে হবে। তার প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে আমি একদিন হুট করে ঘোষণা দিয়ে দিলাম, ঢাকায় আমি নিজেই নিজের খরচা-পাতি চালাবো। এরকম ঘোষণার সাহস অবশ্য পেয়েছিলাম টিউশানীর কল্যাণে।

সেই সময় অল্প কিছুদিনের ব্যবধানে আমি দুটা টিউশানী শুরু করি।
টিউশানী-করুয়াদের কাছে ইংরেজী মাধ্যমের ছাত্রদের বেশ সুনাম রয়েছে। পকেটের স্বাস্থ্য দ্রুত বাড়ানোর জন্যে বাংলার চেয়ে ইংরেজী মাধ্যমের অবদান বেশি থাকে, সাধারণত।

ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণীর এই দুই ছাত্রের বাসা কাছাকাছি। একজনের গুলশান ও অন্যজনের কাকলী- ডিওএইচএস। আমার জন্যে বেশ সুবিধে হলো। ক্লাশের পরে টিএসসিতে ঘন্টাখানেক আড্ডা দিয়ে তারপরে শাহবাগ থেকে ছয় নাম্বার অথবা শাপলা ধরে চলে যেতাম কাকলী। ওখানে পড়ানো শেষে গুলশান।
এই দুই ছাত্রকে পড়ানোর ব্যাপারটা বেশ এনজয় করেছি সবসময়েই।

একজন একটু বেশি মেধাবী ছিলো- খুব সহজে সব পড়া বুঝে যেত, আগ বাড়িয়ে হোমওয়ার্ক নিয়ে নিতো- ওর রেজাল্টও ছিল ক্লাশের প্রথম দিকে।
অন্যজন সেই তুলনায় একটু কম মেধাবী- রেজাল্টের অবস্থা করুণ, এবং আলসেমীতেও জুড়ি নেই।
তবে একটা বিষয়ে দুজনের মধ্যেই বেশ মিল ছিলো- দুজনের কেউই বাংলায় ভালো নয়!

প্রথম যখন একজন থার্টিনাইনকে কোন ভাবেই ঊনচল্লিশ বলে চিনতে পারছিলো না- আমি বেশ অবাক হয়ে যাই। এবং মজার ব্যাপার হলো- দু'জনের মা-ই আমাকে বলেছিলেন, 'বাবা, সব সাবজেক্ট যেমন তেমন, কিন্তু বাংলায় ওরা খুবই উইক। তুমি ওটাতেই বেশি জোর দিও।'

এটা বোধহয় বছর ছয় আগের কথা। তখনও দেশে ডিজ্যুস জমানা আসে নি। আমরা, মানে ম্যাংগো-জনতার বাংলা তখনও সাধারণই ছিলো, কোন কিছুর মিলমিশে এখনকার মতন জগাখিচুড়ী হয়ে যায় নি। কিন্তু সেই সময়েই আমার একজন ছাত্রের স্বপ্নের নায়ক ছিলো মাইকেল জর্ডান, অন্যজনের, ওয়েল, শাহরুখ খান।

আমি ওদের সাথে কথা বলতে গিয়ে দেখলাম বাংলা বা বাংলাদেশ নিয়ে ইতিহাস বা অন্য যে কোন সাধারণ জ্ঞানের জায়গাটায় বিশাল ফাঁক রয়ে গেছে।
এই আবিষ্কারটা আমার জন্যে বেশ পীড়াদায়ক ছিল।
তবে বেশ বুঝতে পেরেছিলাম, এর পেছনে ওদের কোনই দোষ নেই। ওদের পড়ানোর বইপত্র, সিলেবাস, স্কুলের পরিবেশ ও আরো নানান হাবিজাবি এর জন্যে দায়ী- পুরোমাত্রায়। ওরা নিজেরা একেবারেই দায়ী নয়।
আমার মনে হয়েছিলো- যদি সেরকম সাপোর্ট ওদের দেয়া যায়- ব্যাপারটা কাটিয়ে ওঠা অসম্ভব নয়।

আমি খুব অল্প কিছু পদক্ষেপ নিয়ে ছিলাম।
পড়ানোর বাইরের সময়টুকুতে ওদের সাথে আমাদের ভাষা আর দেশ নিয়ে অনেক গল্প করতাম। একদম স্বতস্ফূর্ত বাংলায়। অথবা ওদের বাংলার বিষয়গুলোকেও বেশ সহজ করে গল্পের মত করেই বুঝিয়ে দিতাম। এটা অনেক কাজে লেগেছিলো।
সেই সময় আমি চন্দ্রিলের বেশ ভক্ত ছিলাম। তখন সদ্যই হাতে এসেছিলো চন্দ্রবিন্দুর এলবাম- ত্বকের যত্ন নিন। খুব মজার আর সুন্দর সব গান। একটা গানের নাম ছিলো- বাথরুম। একটা ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের এক সকালের গল্প। যেখানে ছোট এক ছেলের খুব বাথরুম চেপে যায়, কিন্তু থার্ড পিরিয়ডে বাথরুমে যাবার নিয়ম নেই বলে টিচার তাকে কিছুতেই যেতে দিচ্ছে না।

এই দারুন মজার গানটা আমি দুজনকেই শোনালাম।
খুব মজা পেয়ে গেলো ওরা। এই এলবামের অন্য গানগুলোও শুনতে বেশ উৎসাহ দিলাম। ওরা ক্রমশ বাংলা গান শুনতে চাইছে- এই পরিবর্তনটাই তখন বেশ আনন্দদায়ক ছিলো।

বাংলা পড়বার অভ্যেসের জন্যে অনেক ভেবে চিন্তে দু'জনের হাতে তুলে দিলাম সত্যজিৎ রায়ের বই। আমার মনে হচ্ছিলো- এই বয়সের মানসিকতার জন্যে সত্যজিৎই সবচে ভালো সংগী হতে পারবেন।
আমি গল্প বেছে বেছে দিতাম ওদের, পড়বার উৎসাহ দিতাম অনেক। ওরাও বেশ মজা পেয়ে গিয়েছিলো।
আরো মজার ব্যপার হলো- এদের একজন গান শুনতে আগ্রহ পেত বেশি, আর অন্যজন বই পড়তে।
সব মিলিয়ে বছর দুয়েক পড়িয়েছিলাম আমি ওদের। বাংলায় দু'জনের কেউই 'খারাপ' ছিলো না আর।
ওরা বাংলা গান শুনতো, বই পড়তো, সে সব নিয়ে আমার সাথে আলোচনাও করতো! পরীক্ষার খাতায় নম্বরও আসতো বেশ ভালো। একুশ নিয়ে জানতো, মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কথা বলতো, বাংলাদেশের জার্সি পরে টিভিতে খেলা দেখতে বসতো।

পুনশ্চঃ
একদিন পড়াতে গিয়েছি; আমার ছাত্র চকচকে চোখে এসে আমাকে বলছে, 'ভাইয়া, বিরাট জিনিস জোগাড় করে ফেলেছি!'
আমি বললাম, 'কি?'
ও তার কম্পিউটার খুলে দেখালো- তখন পর্যন্ত বের হওয়া চন্দ্রবিন্দুর সবগুলো এলবামের গান একটা ফোল্ডারে।
আমাকে বলে, ' সব শুনে ফেলবো! আর কার কার গান শোনা যায় বলুনতো?"

পুনশ্চ ২:
আমার অন্য ছাত্রের অবস্থাও তথৈবচ। ওর মা এসে একদিন আমাকে বললেন, 'আজ বইমেলায় গিয়ে ও ঘুরে ঘুরে সত্যজিতের সব কালেকশন কিনে ফেললো। ফেলুদা, প্রোফেসর শংকু- সব।'
বেচারা নিজে এসে আমাকে বলতে বেশ লজ্জা পাচ্ছিলো। আন্টির কথার পরে এক এক করে সবগুলো বই এনে আমাকে উল্টে পালটে দেখালো।
নতুন বই পেলেই আমি নাকের কাছে নিয়ে গন্ধ শুঁকি। তাই করতে করতে আমি অনেক কিছু ভাবছিলাম সেদিন।

ঠিকঠাক পরিবেশ আর যত্ন পেলে মানুষের মধ্যে পরিবর্তন আনা যায়- এটা বুঝেছিলাম বেশ ভালমতন।
আরো বুঝেছিলাম- ভালোবাসাকেও মাঝে মাঝে হাতের আঙুল ধরে পথ চলা শুরু করিয়ে দিতে হয়- সেটা দেশের জন্যেই হোক কি ভাষার প্রতি।


Popular posts from this blog

The Boy, the Mole, the Fox and the Horse | Charlie Mackesy

মধ্যাহ্নভোজ | উইলিয়াম সমারসেট মম্‌ | রূপান্তরঃ তারেক নূরুল হাসান

আরেকটিবার-