দিন বাড়ি যায়
পায়ের তলায় চাকা লাগিয়ে দৌড়ুচ্ছি, চৌপর দিনভর ব্যস্ত থাকি।
গত একমাসে প্রায় কিছুই লেখা হয়নি আমার, অবশ্য পড়েছি প্রচুর। সুখের খবর হচ্ছে, পড়তে চাইলে সচলায়তনে এখন লেখার অভাব নেই!
লিখতে চাইনি, তা নয়। গত মাসে পরপর দুই রবিবার দুইটা পহেলা বৈশাখ উদযাপন করে মনে হয়েছিলো, এই নিয়েই লিখি না কেন? বেশ তো মজা হলো। আমাদের দেশীয় উৎসবগুলো নিয়ে এখানে এইসব সমস্যায় পড়তে হয়। যদি উইকেন্ডে আপনা থেকেই না পড়ে, তাহলে জোর করে সেটাকে এনে উইকেন্ডে ফেলে উৎযাপন করা হয়। বৈশাখ তো বৈশাখ, এমনকি ঈদের আনন্দও এইরকম শিফটিং এর কবল থেকে বাঁচতে পারে না সবসময়। দেশে লোকে ঈদ করে চাঁদ দেখে, আমরা এখানে করি উইকেন্ড দেখে।
প্রথম উৎসবে গিয়ে পেটপুরে সিংগারা খেলাম। ফেইস-বুকিশরা জানেন, তার আগের একটা সপ্তাহে আমার হঠাৎ করে সিংগারা-বিরহ শুরু হয়েছিলো। সেটা সামাল দেয়ার জন্যেই একরকম হুড়োহুড়ি করে গেছিলাম বৈশাখ আয়োজনে।
আর ২য় উৎসব হয়েছিলো অনেক বেশি জমজমাট করে, মেলবোর্নের বিখ্যাত ফেডারেশান স্কোয়ারে। সিডনীতে বাংগালী অনেক, বেশ বড় করেই তাই উৎসব হয় ওদের। কিন্তু মেলবোর্নে উৎসব মানেই চেনা-জানা দুতিনটে কম্যুনিটি সেন্টারের কোন একটায় ছোটখাটো আয়োজন। মেলবোর্নবাসী জাতে উঠছে, ফেডারেশান স্কোয়ারে অনুষ্ঠানটা মোটামুটি এইরকমই একটা ঘোষণা বলা যায়। চ্যানেল আই দেখিয়েছে সেটা টিভিতে, নানান রাঘব কোম্পানী স্পন্সর করেছে।
আমি অবশ্য পুরোটা দেখতে পাইনি। সারাদিন কাজ ছিলো, সব শেষ করে আমি যখন পৌঁছুই তখন সমাপনী সংগীত শুরু হয়ে গেছে, তোমার হলো সারা, আমার হলো শুরু।
সেই উৎসবে একজন দীর্ঘদেহীকে দেখে খুব পরিচিত মনে হলো, কিন্তু কিছুতেই মনে করতে পারছি না কোথায় দেখেছি ওনাকে। অনেক চিন্তা ভাবনা করে শেষমেষ কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম সরাসরি। প্রথমে কলেজের নাম বললাম, না, উনি সেখানে পড়েন নি। তারপরে ইউনিভার্সিটির কথা বলতেই মিলে গেল। জানালেন, শহীদুল্লাহ হলে থাকতেন। আমি থাকতাম অমর একুশে হলে। উনি শুনে বললেন শেষের দিকে ওখানেই চলে এসেছিলেন। আমি তো খুব খুশি, ভাই-টাই ডেকে কথা শেষ করে যখন চলে আসছি বাসায়, তখন হুট করে মনে আমার পড়লো ওনাকে তো আসলে সিনিয়র হিসেবে পাইনি ভার্সিটিতে, উনি একুশে হলের হাউস টিউটর ছিলেন! কি সর্বনাশ!
তো এই নিয়েও লিখতে চেয়েছিলাম, কিন্তু সময় পাই নি শেষমেষ।
তারপরে মাঝে আবার উবুন্টু নিয়ে উঠে পড়ে লেগেছিলাম অনেক সময়। ইচ্ছে করে নয় অবশ্য। স্বল্প ড়্যামের ল্যাপটপে ভিস্তা চালানো আর ঘোড়ার রেসে শামুক দৌড়ানো প্রায় সমার্থক। এই ঝামেলা থেকে মুক্ত হতে চেয়েছিলাম অনেক আগেই, কিন্তু বাংলা লেখার জন্যে আমি শতভাগ নির্ভর করি অভ্রের ওপর, এদিকে লিনাক্সে অভ্র না চলায় বাধ্য হয়েই ভিস্তা পুষছিলাম। শাব্দিক নামে ফায়ারফক্সের জন্যে একটা প্লাগইন আছে, যেটা দিয়ে লিনাক্সেও অভ্র ব্যবহার করা যায়, কিন্তু সেটা পুরোপুরি নির্ভুল নয়। চ আর ছ-এ কি এক শত্রুতা বাঁধিয়ে রেখেছে, কিছুতেই তারা যুক্ত হয়ে চায় না, জ্ঞান লিখতে গেলে লিখতে হয় গ্গান। এই মুশকিল সমাধান করছি বড়ই অদ্ভুত উপায়ে। উবুন্টুর ডিফল্ট কি বোর্ড প্রভাতও রেখে দিয়েছি। প্রায় সব লেখাই লিখি শাব্দিক প্লাগইন দিয়ে, লেখা শেষে বানানগুলো ঠিক করি প্রভাত দিয়ে। এইভাবে কতদিন চালাতে হবে বলা মুশকিল, কারণ শুনেছি অভ্র-র হর্তাকর্তাদের লিনাক্স খুব একটা প্রিয় নয়।
এই জোড়াতালির কষ্টের কথাও লিখব ভেবেছিলাম একদিন, হলো না।
আবার সচলায়তনে যখন এই সময়ের বাংলা গান নিয়ে বেশ জোর তর্কালোচনা চলছিলো, আমি চুপচাপ পড়ে গেছি। অনেকদিন আগে একবার ছয় নম্বর বাস অথবা হয়তো শাপলা সার্ভিসে অথবা অন্য কোন বাসে চড়ে টিউশানিতে যাচ্ছিলাম। যেতে যেতে দেখি আমার পেছনের কোন একটা সীটে বছর পঁচিশের এক ছেলে হাতে একটা বই ধরে বসে আছে। সন্ধা হয়ে গিয়েছিলো, বাস চলতে চলতেই বাসের ভেতরের অথবা বাইরের রাস্তার আলো এসে পড়লে, সেই আলোয় সেই ছেলে বই পড়ে, আর পড়তে পড়তে আবেগে চোখ মুছে। এই দৃশ্য দেখে আমি অভিভূত হয়ে পড়ি, সেই লেখকের নাম জানার জন্যে উদগ্রীব হয়ে পড়ি মুহুর্তেই, কিন্তু কিছুতেই সেই সার্থক লেখকের নাম দেখতে পাই না। অবশেষে, আর কিছু পরেই যখন আমাকে বাস থেকে নেমে যেতে হবে, তাই আর থাকতে না পেরে খানিকটা নির্লজ্জ হয়েই মাথা পুরো ঘুরিয়ে দেখে নিলাম লেখকের নাম, আর দেখে ভীষণ অবাক হলাম। না, আমার চেনা-জানা অথবা সুপরিচিত কোন লেখকের বই ছিলো না তা, কী নাম ছিলো এতদিন পরে আর মনে করতেও পারছি না, হয়তো ছিলো কাশেম বিন আবুবকর, অথবা নিশাত চৌধুরী বা অন্য কেউ। কিন্তু তারপর থেকে আমি আর বই বা গানের পছন্দ নিয়ে বড় একটা আলাপে যাই না। কার যে কী ভাল লাগে, কে-ই বা তা জানে! আমার নিজের ভেতরেও কত রকমের স্ববিরোধীতা! আনিলা বা এলিটার গান খুব ভাল লাগে কিন্তু এদিকে মিলা বা ইভা রহমান শুনলে গা রিরি করে ওঠে। ফরিদা পারভীন শুনে চুপ করে বসে রই, আবার চুপটি করেই শুনি আনুশেহ। হাবিবের কিছু ভাল লাগে, কিছু মন্দ লাগে, আর ফুয়াদকে শুনতে পারি না একদমই। কিন্তু আমার সবচেয়ে অবাক লাগে এদের সাথে এক সমতলে কেউ যখন অর্ণবের নাম নেয়! মন দিয়ে গান শোনে আর প্রাণে সেটা অনুভব করে এমন কারো এরকম ভুল হতে পারে বলে আমি মনে করি না। বাঙ্গালী মাত্রই লেট লতিফ, সময়ে লোকের মূল্যায়ন করতে জানে না, দেরি করে ফেলে সবসময়েই। আজ থেকে বছর কুড়ি বাদে এই সময়ের গানকে যদি কেউ অর্ণব যুগের গান বলে পরিচয় করিয়ে দেয়, এই আমি অন্তত অবাক হবো না।
তো লিখতে চেয়েছিলাম এই বহু পুরনো গল্পের কথা, চেয়েছিলাম অর্ণবের কথা বলতে, কিন্তু সময় হলো না।
এর মাঝে আরো অনেক কিছুই হলো। পদ্মায় নতুন করে চর পড়লো, আমার ওজন বেড়ে গেলো প্রায় কেজির কাছাকাছি, অস্ট্রেলীয় সৈনিক মারা গেল পরবাসী যুদ্ধে, এক ভারতীয় ট্যাক্সি ড্রাইভারকে কারা যেন ছোরা মারলো এখানে, পার হয়ে গেল আমার বস সত্যজিতের জন্মদিন। এ সব কিছু নিয়েই কত কী লেখার ছিলো, কিন্তু আর হলো কই!
এই করে করে চলেই এল পঁচিশে বৈশাখ। এই এক আশ্চর্য দিন। এমনকি এই জবরজং শীতের জংলা কুয়াশারও যেন মনে থাকে এই দিনের কথা। আমার ঘরে গীতবিতান খোলা হয়, নেটে বসে রবি দাদুকে সেলাম ঠুকি বারে বারে। তারপর আয়েশ করে গা এলিয়ে দিয়ে শুনি পাশ থেকে বউ গুন গুন করে গাইছে, আমায় নহে গো ভালবাসো শুধু, ভালবাসো মোর গান। হুম, নজরুল গেয়েই তাহলে রবিকে শুভেচ্ছা জানানো? তবে তাই হোক।
আর এইসব টুকরো টাকরা ভাবনা আর কয়েক চিমটি স্মৃতি মিলিয়ে আমি শেষ মেষ লিখেই ফেলি আমার দিন যাপনের গালগপ্পো।