জুবায়ের ভাই...

অর্ধেকটা জীবন পেরিয়ে এসে আত্মীয়-অনাত্মীয় নানা জনের বিদায়ে শোকাহত হয়েছি, কিন্তু বন্ধু বিয়োগের ব্যথা এই প্রথম পেতে হলো। অনেক দিন বাদে আজ কারো বিদায়ে তীব্র কষ্ট হচ্ছে, হু হু কান্নায় ভরে যাচ্ছে চোখ।

সচলায়তনের পাতা উলটে পুরনো লেখায় চোখ বুলিয়ে যাচ্ছি, কেমন করে বিশ্বাস করি এত প্রাণবন্ত লেখাগুলোর পেছনের মানুষটা এখন আর নেই!
ব্যক্তিগত মেসেজে যেটুকু আলাপ, খুঁজে খুঁজে পড়ছি বারবার, আর চোখ ভিজে আসছে কেবলই।

সচলের পাতায় কার যেন কোন একটা গল্পে আদর করে ভুল ধরিয়ে দিয়েছিলেন কিছু। আমি একদম পেয়ে বসি তারপরে, বললাম, এই প্র্যাকটিসটা চালু রাখা দরকার, আপনি নিয়মিত করুন এই কাজটা। হেসে আমাকে মেসেজ দিলেন, আমি কি তবে কানাই মাস্টার? তবে কখনোই তাঁর কথায় মাস্টারি ছিলো না কোন কালে, এত বড় একটা মানুষ, তবু কি অদ্ভুতভাবে কেবলই একজন ভাল বন্ধুর মতন মন্তব্য করতেন প্রতিটি লেখায়।

সচলে আসা তার একটা উপন্যাসের খুব কড়া সমালোচনা করেছিলাম একবার। আর কেউ হলে ওরকম কঠিন করে প্রতিক্রিয়া জানাতে পারতাম কি? মনে হয়, না। জুবায়ের ভাই বলেই পেরেছি। এবং শান্তি পেয়েছি তার প্রতিক্রিয়া পড়ে, তিনি ভীষণ খুশি এরকম সমালোচনায়- মন্তব্যে পাঁচ তারা দিতে চাইলেন!

আমাকে ফাঁকিবাজ বলেছেন বেশ কবার, ঘুরিয়ে ফিরিয়ে। তাঁর অনেকগুলো সিরিজ লেখা পড়তে পড়তে মাঝপথে থেমে গেছি, মন্তব্য করবো বলে মেসেজে জানিয়ে আর করিনি, সময় পাইনি নানা কারণে। আমাকে মনে করিয়ে দিয়েছেন, আমি সময়ের দোহাই দিতেই প্রশ্রয় দিয়ে বলেছেন, ঠিকাছে। বেশ কদিন আগে আমার ঝুম্পা লাহিড়িকে নিয়ে লেখা পোস্টটায় জানালেন, ঝুম্পার গল্প নিয়ে কিছুমাত্র দ্বিমত নেই আপনার সাথে, আমার কথাগুলোও আপনি বলে দিয়েছেন। আমি তাঁকে ধরলাম এবার ফাঁকিবাজ বলে, বললাম, এ কথা বললে চলবে না, আপনার পোস্টও পড়তে চাই।
কিন্তু জুবায়ের ভাই এবার সত্যিই ফাঁকি দিয়ে গেলেন!

সচলায়তনের শুরুতে মনে আছে, কোন কোন বিষয়ে তর্ক হতো তখন। সে সময়গুলোয় জেনেছি তিনি বেশ একরোখাও আছেন। তারপরে দিন যেতে থাকলে, ক্রমশ সচলায়তনের সবচেয়ে শুভাকাঙ্ক্ষীদের একজন হয়ে যান তিনি। চাইলেই পরামর্শ পাওয়া যেত যে কোন বিষয়ে, নিজে থেকে খবর নিতেন কোথাও কোন সমস্যা হলেই। সবসময়ে বন্ধুর মত পাশে থেকেছেন।
আমার গল্পগুলো নিয়ে ব্যক্তিগত মেসেজে লিখেছিলেন অনেক কিছু। তাঁর মন্তব্যগুলোর কথা মনে পড়ে যাচ্ছে কেবল- সমান্তরাল নিয়ে বলেছিলেন, এই গল্পটি উপন্যাসের উপাদানে ঠাসা। ভেবে দেখবেন উপন্যাসের বিস্তৃতি দিতে চান কি না। অথবা পুরো গল্প থেকে একটা লাইন কোট করে মন্তব্য করেছিলেন, “বাবাকে সেদিন শীতের কুয়াশা কেটে কেটে নদীর ওপার থেকে ক্রমশ কাছে এগিয়ে আসা ডিঙি নৌকার মাঝির মত লাগছিল আমার কাছে - মনে আছে৷” – এই বর্ণনাটি অসাধারণ। - ভীষণ সম্মানিত বোধ করেছিলাম তখন।
লেখা পড়ে ভাল লাগলে জিজ্ঞেস করতেন, পত্রিকায় কেন পাঠাই না লেখা? আমি হেসে বলতাম, আমাকে দিয়ে হবে না। কিন্তু তিনি সাহস দিতেন, আবার পরামর্শও। বলেছেন ছদ্মনামে না লিখে আসল নামে লিখতে, গল্পলেখক হিসেব কনফুসিয়াস-এর বদলে নূরুল হাসানকে পাঠক বেশি গ্রহণযোগ্য মনে করবে বলে আমার বিশ্বাস। এরকম সদয় মন্তব্য আর কার কাছ থেকে পাবো!

ব্লগের পাতায়, মেসেজের ভিড়ে এত এত আলাপের স্মৃতি আজ কেবলই দুর্বল করে দিচ্ছে বারে বারে। জুবায়ের ভাই নানা বিষয়েই বারে বারে চমকে দিয়েছেন আমাকে। নিজেকে কম্পুকানা প্রজন্মের প্রতিনিধি বলতেন, তবু ব্লগিং করতেন নিয়মিত। লেখা নিয়ে উচ্ছ্বাস বা পরামর্শ জানাতে চাইলে, বিব্রত যেন না হই, এই চিন্তায় মেসেজে টোকা দিয়ে জানাতেন। এইরকম স্বজনসুলভ ব্যবহার ব্লগে প্রথম ওনার কাছ থেকেই পেয়েছি।
হায়, আজ স্বজন হারাবার বেদনাও প্রথম পেতে হলো এই জুবায়ের ভাইয়ের কাছ থেকেই!

Popular posts from this blog

The Boy, the Mole, the Fox and the Horse | Charlie Mackesy

মধ্যাহ্নভোজ | উইলিয়াম সমারসেট মম্‌ | রূপান্তরঃ তারেক নূরুল হাসান

আরেকটিবার-