নিজে মরতে চাইলে মরুন, দয়া করে অন্যদের মারবেন না-


ঊনিশ বছর বয়েসী এই ছেলেটির নাম পুনিত। ভারতীয় ছেলে, ছাত্র হিসেবে পড়তে এসেছে অস্ট্রেলিয়ায়। অনুতাপে ভরা এই কমবয়েসী মুখখানা দেখে অনেকেরই মনে মায়া জাগছে জানি, কিন্তু আমার জাগছে না, বদলে কেবলই তীব্র রাগ হচ্ছে ভেতরে।
এই ছেলেটি দুদিন আগে গাড়ি দুর্ঘটনায় পড়ে, ফলাফল- একজন পথচারী ওখানেই নিহত, অন্যজন গুরুতর আহত হয়ে হাসপাতালে।
আমি জানি, দুর্ঘটনা দুর্ঘটনাই, কারও হাত নেই সেখানে। কিন্তু দুর্ঘটনার পেছনে যদি থেকে থাকে কারো দায়িত্বজ্ঞানহীনতা, কি বলবেন তখন?
পুনিত নামের এই ছেলেটি সেদিন রাতে তার কলিগদের সাথে পার্টি শেষ করে গাড়ি চালিয়ে ফিরছিলো শহরে। পার্টিতে চার বোতল স্কচ আর কোলা পান করে সে। ফিরবার পথেই দুর্ঘটনায় পড়ে, গাড়ি নিয়ে সোজা ধাক্কা দেয় রাস্তার পাশের গাছে, তারপরে ট্রাফিক লাইটে, অতঃপর পাশের হোটেলের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা দুজন মানুষের ওপরে পড়ে তার গাড়ি। তাদের একজন নিহত হলেও পুনিত প্রাণে বেঁচে গেছে।
পুলিশের জেরায় পুনিত শুনিয়েছে এক অদ্ভুত কাহিনি। সে বলেছে, গাড়ি চালানোর সময় তার চোখ ব্যথা করছিলো, খানিকক্ষণ চোখ বুজেও (!!) ছিল সে, চোখ খুলতেই দেখে গাড়ির সামনে কোথা থেকে একটা বিড়াল এসে পড়েছে, সেটাকে বাঁচিয়ে পাশ কাটাতে যেতেই ঘটে দুর্ঘটনা।
এই কথার সত্য মিথ্যা জানা যায়নি।
পুলিশ তার রক্ত পরীক্ষা করে তাতে এলকোহলের মাত্রা পেয়েছে দশমিক ১৬৫। যেখানে আইনী সীমা মাত্র দশমিক শূন্য পাঁচ। প্রায় তিনগুণ। পুলিশি তদন্তে আরো জানা গেছে, সর্বোচ্চ ৬০কিমি/ঘন্টা স্পিড জোনে পুনিত তখন গাড়ি চালাচ্ছিলো ১৫০ কিমি/ঘন্টায়!
মনের ভেতর থেকে একটা তীব্র গালিই শুধু বেরিয়ে আসছে কেবল- ব্যাটা আহাম্মক!
*
যে ছেলেটি মারা গেছে তার নাম ডিন হফস্টি। গ্রিফিথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলো সে, বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে এসেছিলো নিজ শহর থেকে মেলবোর্নে। এসে, লাশ হয়ে ফিরে গেল বাবা-মায়ের কাছে।
ডিনের বাবা-মায়ের দুঃখভরা কথামালা ছাপা হয়েছে পত্রিকার পাতায়। তার আত্নীয়েরা বলছে, ভীষণই প্রাণবন্ত ছিলো ডিন, ও ছিলো লার্জার দ্যান লাইফ।
*
পুনিতেরও পেছনের গল্প আছে একটা আমি জানি। সে গল্প শুনলে হয়তো আমার মনেও খানিকটা দয়া হবে তার জন্যে, মনে হবে, আহা বেচারা।
কিন্তু আমি কিছুতেই সেই গল্প শুনতে চাই না, তার প্রতি মায়া জন্মানোর কোন ইচ্ছে আমার নেই।

পুনিত নিজেও খুব অনুতপ্ত, বলছে, বাবা-মাকে মুখ দেখাতে পারবে না।
বলছে, নিহত মানুষটির পরিবারের কাছে সে ক্ষমাপ্রার্থী।
বলেছে, আর কখনই সে গাড়ি চালাবে না।

কিন্তু এ সবের আর কোনই কি মানে আছে আর এখন? একটা মানুষের জীবন শেষ করে দিয়ে তার এই যে উপলব্ধি, এর কি-ই বা মূল্য আছে ডিনের বাবা-মার কাছে?
নেই, কোন মূল্য নেই, কচুটিও নেই। আমি জানি। বুকের মানিককে উপড়ে মেরে ফেলে, এইসব মধুবর্ষী কথাবার্তায় আর মধু খুঁজে পাওয়া যায় না, কেবলই বিষের মতন লাগে।
*
ডিনের বাবা-মার জন্যে এই অখ্যাত বাংলাদেশী ছদ্মনামী ব্লগারের পক্ষ থেকে গভীর সমবেদনা রইলো। তিনবছর আগে সড়ক দুর্ঘটনায় সবচেয়ে প্রিয় মানুষটিকে হারানোর বেদনায় বুক ভেঙেছিলো আমারও, আপনাদের কষ্ট আমি সম্ভবত বুঝতে পারি।

*
আর সবাইকে বলি, মদ খান গলা ডুবিয়ে, আমাদের আপত্তি নেই। মাতলামি করুন, আমরা গেলাস ঠুকে বা না ঠুকেই শুভেচ্ছা জানাবো- চিয়ার্স।
কিন্তু মাতাল হয়ে দয়া করে গাড়ি চালাবেন না।
দুর্ঘটনা, দুর্ঘটনাই থাকুক, সেটাকে কাছে ডেকে না আনলেই আমরা খুশি হবো।
খুব ইচ্ছে হলে নিজে গিয়ে লাফিয়ে মরুনগে কোন দশতলা দালান থেকে, কিন্তু দয়া করে, মাতাল হয়ে গাড়ি চালিয়ে আমাদের মারবেন না।


ছবিঃ দি অস্ট্রেলিয়ান/ হেরাল্ড সান ।

Popular posts from this blog

The Boy, the Mole, the Fox and the Horse | Charlie Mackesy

মধ্যাহ্নভোজ | উইলিয়াম সমারসেট মম্‌ | রূপান্তরঃ তারেক নূরুল হাসান

আরেকটিবার-