আশ্চর্য তীর্থযাত্রীরা ০৩

আমার মনে আছে, ১৯৭৮ সাল পর্যন্ত আমার সেই নোটখাতাটা আমার ডেস্কের ওপরেই অনেকগুলো কাগজের নীচে ডুবে ছিলো। একদিন, অন্য কী একটা খুঁজতে গিয়ে আমি টের পেলাম, খাতাটা আমি বেশ কদিন ধরেই দেখছি না। তাতে অবশ্য তেমন কিছু যায় আসে না। কিন্তু যখন আমি নিশ্চিত হলাম যে খাতাটা সত্যিই ডেস্কে কোথাও নেই, আমি রীতিমতন আতঙ্কিত হলাম। বাড়ির প্রতিটি কোণ খুঁজে দেখা হলো। আমরা আসবাব সরিয়ে খুঁজলাম, এমন কি লাইব্রেরীর তাক সরিয়ে সরিয়ে দেখা হলো বইয়ের ফাঁকে কোথাও খাতাটা পড়ে যায়নি এ ব্যাপারে নিশ্চিত হবার জন্য। গৃহ পরিচারক এবং আমাদের বন্ধুদেরও জেরা করা হলো। কিন্তু কোথাও কোন খোঁজ পাওয়া যাচ্ছিলো না। একমাত্র সম্ভাবনা এবং যুক্তিসঙ্গত ব্যাখ্যা একটাই হতে পারে, প্রায়শই আমি যখন পুরনো কাগজ পাতি দুম করে ফেলে দিই, খাতাটাও হয়তো তখুনি ময়লার ঝুড়িতে চলে গেছে।

এখানে আমি বিরাট কারচুপি করলাম আবারও। বারবারই এই নতুন দ্বন্ধের সাথে আমার পরিচয় ঘটছে। পড়ে যা বুঝছি, মাথায় যেটা থাকছে, অনুবাদিত বাংলায় সেটা আসছে না। আরও অনেক ভাবা দরকার আমার বুঝতে পারছি, কিন্তু ধৈর্য্যে কুলাচ্ছে না। এটাকে চূড়ান্ত করবার আগে অবশ্যই আমার এ ব্যাপারগুলো নিয়ে আবার বসতে হবে। অথবা না-ও বসতে পারি। যেমন আছে তেমনই থেকে যেতে পারে।

আমার নিজের প্রতিক্রিয়া আমাকে বিস্মিত করলোঃ যে বিষয়গুলো আমি প্রায় চার বছর ধরে ভুলে বসে আছি সেগুলোই আমার সম্মানের রক্ষার ব্যাপার হয়ে দাঁড়ালো। যে কোন মূল্যেই তাদের পুনরুদ্ধারের ব্যাপারে উদ্যোগ নিলাম, এবং লেখালেখির মতই কষ্টসাধ্য শ্রম দিয়ে আমি প্রায় ত্রিশটি গল্পের বিষয়গুলোকে আবারো লিখতে সমর্থ হলাম। মনে করে করে লিখবার এই প্রক্রিয়াটি অনেকটা পরিশোধন প্রক্রিয়া হিসেবে কাজ করছিল। এ কারণেই যে গল্পগুলো উদ্ধার করা অসম্ভব মনে হচ্ছিলো, আমি তাদের নির্দয়ভাবে বাদ দিয়ে দিয়েছি এবং শেষ মেষ আমার হাতে গল্প বাকি রইলো আর আঠারোটি। এবার আমি দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হলাম যে কোন বিরতি ছাড়াই সবগুলো গল্প আমি লিখে ফেলবো, কিন্তু শিগগিরই আমি ওদের প্রতি আবারো উৎসাহ হারিয়ে ফেললাম। এবং নতুন লেখকদের আমি সাধারণত যে উপদেশ দিই, নিজে করলাম তার ঠিক উল্টোটা, আমি সেগুলোকে ছুঁড়ে ফেলে দিলাম না। তার বদলে যদি কখনো কাজে লাগে, এই ভেবে আমি তাদের ফাইলবন্দী করে রাখলাম।
১৯৭৯ সালে আমি যখন Chronicles of a Death Foretold লিখতে শুরু করি, তখন নিশ্চিত হলাম যে দুই বইয়ের মাঝের সময়টাতে আমি লেখার অভ্যাস হারিয়ে ফেলি, এবং আবার নতুন করে শুরু করাটা ক্রমশই আমার জন্যে কঠিনতর হতে থাকে। এ কারণেই ১৯৮০ সালের অক্টোবর থেকে ১৯৮৪ এর মার্চ মাস পর্যন্ত আমি প্রতি সপ্তাহে বিভিন্ন দেশের পত্রিকার জন্যে একটি করে মন্তব্য-প্রতিবেদন লিখবো বলে ঠিক করলাম, অনেকটা লেখার অভ্যাসটাকে জিইয়ে রাখার জন্যেই। সে সময় আবার আমার হঠাৎই মনে হলো নোটখাতার এই বিষয়গুলো পুরোপুরি সাহিত্য-ধাঁচের নয়, এবং এদের গল্পের চেয়ে সংবাদপত্রের নিবন্ধ হিসেবেই বেশি মানাবে। সুতরাং নোটবইয়ের বিষয়বস্তু দিয়ে পাঁচটি মন্তব্য-প্রতিবেদন প্রকাশিত হওয়ার পরে আমি আবারও মত বদলালাম, মনে হলো তারচেয়ে ভাল হবে চলচ্চিত্র হিসেবেই। ঠিক এভাবেই পাঁচটি চলচ্চিত্র এবং একটি টেলিভিশন ধারাবাহিক তৈরি হয়েছিলো।

এই পর্যন্ত অনুবাদ করে ফেলার পর আমার হাতে এই লেখাটারই আরেকটা বাংলা অনুবাদ চলে এলো নজরুল ভাইয়ের কল্যাণে। আলী আহমেদের করা এই অনুবাদটার খোঁজ জানার পরে নজরুল ভাইয়ের কাছে চাইতেই উনি সাঙ্ঘাতিক একটা কাজ করলেন, পুরো অনুবাদটা আমাকে কম্পোজ করে পাঠিয়ে দিলেন! আমি রীতিমতন বিস্ময়াভিভূত!
আরেকটা অনুবাদের উপস্থিতি আমাকে বেশ খানিকটা অলস বানিয়ে ফেললো, ভাবছিলাম আর নাই বা করি। কিন্তু আবার মনে হচ্ছিলো, একেবারে অসমাপ্ত রাখাটাও ঠিক হবে না। শুরু যখন করেইছি, শেষ করে ফেলা যাক।
আলী আহমেদের অনুবাদটা পড়া শুরু করলাম। দু প্যারা পড়ার পড়েই বেশ সাবধান হয়ে গেলাম। ঠিক করলাম, আমার যেটুকু শেষ হয়েছে, কেবল সেটুকু পর্যন্তই আলী আহমেদের অনুবাদটি পড়বো, তার বেশি নয়। তবে পড়তে গিয়ে আমার জন্যে আসলে বেশ ভালই হলো, বেশ কিছু অংশে আমার অল্প-বিস্তর খটকা দুর হয়ে গেলো। আমার মনে হলো, পুরোটা অনুবাদের কাজ শেষ করে যদি আরেকবার আমার লেখাটাকে ঘষামাজা করে দাঁড় করাতে চাই, তাহলে আলী আহমেদের অনুবাদটি আমার বেশ কাজে আসবে।

আগে মাথায় আসেনি এরকমটা হবে, তবে শেষে তাই হলো যে চলচ্চিত্র আর সাংবাদিকতার কাজ গল্পগুলো নিয়ে আমার ধারণা কিছুটা পাল্টে দিলো। এবং যখন এদের চুড়ান্ত রূপ দিলাম, তখন চিত্রনাট্য লেখার সময়ে পরিচালকদের দেয়া আইডিয়াগুলো থেকে আমার নিজের আইডিয়াগুলোকে খুবই সতর্কতার সাথে আলাদা করে নিলাম। বাস্তবিক, পাঁচজন ভিন্ন ভিন্ন পরিচালকের সাথে কাজ করতে গিয়ে গল্পগুলো লিখে ফেলা নিয়ে আমি আলাদা একটি পদ্ধতি পেয়ে গেলামঃ অবসর পেলেই আমি একটা গল্প লিখতে শুরু করতাম, ক্লান্ত হয়ে পড়লে বা হঠাৎ আর কোন প্রকল্পে ব্যস্ত হয়ে পড়লে তখুনি তা থামিয়ে দিতাম, এবং তারপরে অন্য আরেকটা গল্প শুরু করে দিতাম। এক বছরের কিছু কম সময়ের মধ্যে আঠারোটির মধ্যে ছয়টি গল্পই ময়লার ঝুড়িতে জায়গা করে নিলো, তাদের মধ্যে একটি আবার ছিলো আমার নিজের শেষকৃত্যের গল্প নিয়ে, কারণ স্বপ্নের উদ্দাম আনন্দটুকু আমি কিছুতেই লেখায় তুলে আনতে পারছিলাম না। যাই হোক, বাকি গল্পগুলো দীর্ঘ যাত্রার জন্যে তৈরি হয়ে গেলো।

এই ছোট্ট অনুবাদের কাজটি করতে গিয়ে আমি আনমনেই নিজের জন্যে একটা, যাকে বলে, কার্যপ্রণালী ঠিক করে ফেলেছিলাম। মানে হেন করবো, কিন্তু তেন করবো না। বা এটা এড়িয়ে চলবো, কিন্তু ওটা ঠিকাছে।
তো, শেষ প্যারাটায় আমি নিজের বানানো কার্যপ্রণালী বেশ কিছু জায়গায় অমান্য করলাম। শেষের দুটি লাইন প্রথমে আক্ষরিক অনুবাদের পরে আমার সেগুলোকে ভিনগ্রহী ভাষা বলে মনে হচ্ছিলো। মানে, আলাদা করে শব্দগুলো বাংলাই, কিন্তু সব মিলিয়ে সেগুলো আসলে কোন অর্থ দাঁড়া করছে না। তাই বাক্যগুলোকে অর্থবহ করার জন্যে, আমি প্রথমে আক্ষরিক অনুবাদ করে ফেলে, ইংরেজী মূল বাক্যটাকে পুরোপুরি ভুলে গিয়ে বাংলা বাক্যটাকে নিয়েই কিছুক্ষণ লোফালুফি চালালাম, শব্দ এদিক ওদিক করে বা প্রতিশব্দ বসিয়ে শেষমেষ অর্থবহ করা গেলো।
একই সাথে আরেকটা কাজ করলাম, এই লোফালুফি পদ্ধতিটাকে আমার অদৃশ্য কার্যপ্রণালীর নতুন একটা পয়েন্ট হিসাবে যুক্ত করে দিলাম।

এই বইয়ের গল্পগুলোই ওই বাকি বারোটি গল্প। আরও দুবছর ধরে অল্প অল্প ঘষা-মাজার পরে গত সেপ্টেম্বরে এগুলো ছাপার জন্যে তৈরি হয়ে গেলো। এবং যদি চুড়ান্ত মুহুর্তে মনে জন্ম নেয়া একটি সন্দেহ আমাকে যন্ত্রণা না দিতো, তাহলে ওখানেই তাদের ময়লার ঝুড়িতে যাওয়া-আসার সীমাহীন অভিযাত্রার সমাপ্তি ঘটতো। যেহেতু গল্পগুলোয় আমি মূলত স্মৃতি থেকে ইউরোপিয়ান শহরগুলোর বর্ণনা দিয়েছি, আমার একটু যাচাই করে নেবার ইচ্ছে হলো যে বিশ বছর পরে স্মৃতি নির্ভুল ছিলো কি না। সুতরাং অতিসত্বর আমি বার্সেলোনা, জেনেভা, রোম এবং প্যারিসের সাথে আগের পরিচয় ঝালাইয়ের উদ্দেশ্যে জায়গাগুলো ঘুরে দেখে এলাম।

এই প্যারাটা লিখবার পরে বিরাট একটা ঝামেলা হয়ে গেলো। বাংলায় এটুকু পড়ার পরে নতুন একটা চিন্তা মাথায় এলো, মার্কেজ পুরো লেখাটায় মূলত গল্পগুলোর গল্প হয়ে ওঠার যাত্রাটুকু বর্ণনা করেছেন। শুরুতে গন্তব্য বিবেচনায় এটাকে তীর্থযাত্রা ভেবে নিতেই ভাল লাগছিলো, কিন্তু এখন আবার মনে হচ্ছে, যদি যাত্রাপথের বর্ণনাই অভীষ্ট হয়, তাহলে এদের অভিযাত্রী বলাটাই ভাল হবে কি না?
নাহ, এখনো বুঝছি না, পচুর গিয়ানজাম মনে হচ্ছে!

( ক্রমশঃ)

Popular posts from this blog

The Boy, the Mole, the Fox and the Horse | Charlie Mackesy

মধ্যাহ্নভোজ | উইলিয়াম সমারসেট মম্‌ | রূপান্তরঃ তারেক নূরুল হাসান

আরেকটিবার-