আপনার সন্তানকে অন্তত এই বইটি পড়তে দিন-

একদম পলকা একটা বই। বড় বড় হরফে ছাপা সবমিলিয়ে মাত্র ৬৪ পৃষ্ঠা। তার নিজস্ব ওজনের সিংহভাগই হচ্ছে শক্ত বাঁধাইয়ের কল্যাণে। আমার খাবার টেবলের পাশে রাখা ওজন মাপার মেশিনটায় তুললে কাঁটা খুব একটা নড়ে চড়ে না, দেখেছি। কিন্তু পড়তে গিয়ে যতবারই বুকের ওপর রেখেছি, মনে হয়েছে, এর চেয়ে ওজনদার বা ভারী কিছু বোধহয় আর নেই!
বইয়ের নাম, একাত্তরের কিশোর মুক্তিযোদ্ধা। মেজর হামিদুল হোসেন তারেক বীর বিক্রমের লেখা বই। একাত্তর সালে লেখক নিজেও কমবয়েসী ছিলেন, হায়ার সেকেন্ডারীতে পড়তেন। তবু সেই সময়েই তিনি যুদ্ধে চলে যান; এবং দেশের নানা জায়গায় তিনি সাহসিকতার সাথে যুদ্ধ করেন।
এই বইটি অবশ্য মেজর হামিদুল হোসেনের নিজের গল্প নয়। মুক্তিযুদ্ধের সময়ে তিনি বেশ কয়েকজন কিশোরের সংস্পর্শে আসেন যারা নানা ভাবে যুদ্ধের ময়দানে তাঁকে সহযোগীতা করেছিলো। সেইসব কিশোরদের নিয়ে স্মৃতিচারণ করেই এই বই।

সাতটি আলাদা অনুচ্ছেদে সাতজন কিশোর কিশোরীর কথা আছে এখানে। রমজান আলী, শশীলাল চর্মকার, নুরু নাপিত, পুতুল, আজিজ মন্ডল, বারেক ও তোতা।
মেজর হামিদুল হোসেন নিয়মিত সাহিত্যিক নন। এই বইটির ভাষায় তাই তেমন কোন মাধুর্য্য নেই। একদম সোজা সাপ্টা লেখা। লেখকের বাংলাও খুব যে ভাল নয়, সেটাও স্পষ্ট হয় কিছু কিছু শব্দের ব্যবহার বা বাক্যের গঠন দেখলেই। কিন্তু, এটা এমনই একটা বই, ভাষার সৌন্দর্য্য যেখানে খুব একটা গুরুত্ব বহন করে না। এই বইয়ের ভাষার উৎপত্তি কলমের মাথা থেকে নয় বলেই বোধ হয়। এটার উৎপত্তি ভিন্ন কোন জায়গা থেকে, বুকের খুব গভীরের, প্রাণের কাছাকাছি কোন চোরাকুঠুরি থেকে।

শশীলাল চর্মকার বা নূর মোহাম্মদ নাপিত, যারা পরিবার হারিয়ে এখানে ওখানে ঠোকর খাচ্ছিলো, পরে লেখকের দলের সাথে জড়িয়ে পড়ে এরা, নানা অভিযান সফল করে তুলতে বিস্তর ভূমিকা রাখে। পুতুল নামে এক কিশোরীর কথা আছে, যে পাকবাহিনীর গায়ে গ্রেনেড ছুঁড়ে বাঁচিয়ে দিয়েছিলো কজন মুক্তিযোদ্ধাকে। এরকম এক এক করে প্রত্যেকের অসীম সাহসিকতার কথা বলা এই বইয়ে।

রমজান আলী নামে এক কিশোরের কথা বলেছেন লেখক, রাজাকার সন্দেহে লেখকের দলের মুক্তিযোদ্ধারা যাকে ধরে এনেছিলো। পরে আসল ঘটনা জানা যায়। বিহারীরা ওর পুরো পরিবারকে মেরে ঘরদোর জালিয়ে দেয়। পরে যার আশ্রয়ে যায় রমজান, তার দোকানে এক রাজাকার কমান্ডারের আনা গোনা ছিলো, ওখান থেকেই রমজানকে নিয়ে যায় সে। সেখান থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে এসে পুর দস্তুর যোদ্ধা বনে যায় সে। শত্রুপক্ষের খবর নিয়ে আসে, সরাসরি যুদ্ধেও অংশ নেয়। এবং একটা অপারেশনে গিয়ে রমজান পাকসেনাদের পাতানো মাইনে পা দিয়ে ফেলে, তার দেহ ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়। শহীদ হয় কিশোর মুক্তিযোদ্ধা রমজান।

বইয়ের প্রতিটি কিশোর মুক্তিযোদ্ধার কথা পড়তে গিয়ে গলা বুজে আসে। কী ভাগ্য আমাদের যে শুধু কষ্ট করে আমাদের একটু জন্মাতে হয়েছে, সাথে সাথে বিনেপয়সায় একটা দেশ পেয়ে গেছি আমরা। অথচ এই দেশটাকে আনবার জন্যে কত কত মানুষের রক্ত অশ্রু আর ত্যাগ যে জড়িয়ে আছে, তার কিছুই আমরা জানি না!

এমাজন ডট কমে দেখলাম হ্যারি পটারের নতুন বইটার দাম বাংলাদেশী টাকায় সাড়ে নয়শো টাকা। আর একাত্তরের কিশোর মুক্তিযোদ্ধা বইটির মূল্য ঠিক তার ষোল ভাগের একভাগ, মাত্র ষাট টাকা।
উঁহু, যারা ভাবছেন হ্যারিকে পছন্দ করি না আমি, ভুল ভাবছেন। রূপকথার আমি আজীবন ভক্ত, হ্যারি ও তার বন্ধুরা আমার কম প্রিয় নয়। আজকের শিশুরা হ্যারি পটার পড়তে পড়তে বড় হোক, এ নিয়ে আমার বিন্দুমাত্র আপত্তি নেই। আমি শুধু চাইবো, হ্যারি পটারের সাথে সাথে আপনারা আপনাদের সন্তানের হাতে একটি করে একাত্তরের কিশোর মুক্তিযোদ্ধা বইটিও তুলে দিন।

রূপকথার জাদুকর কিশোরকে স্বপ্নের নায়ক ভেবে নিক নতুন প্রজন্ম, সমস্যা নেই, কিন্তু সেই সাথে জীবন যুদ্ধের যারা সত্যিকারের নায়ক, তাদের যেন জানতে পারে তারা, চিনতে পারে; তাতে যেন ভুল না হয় আমাদের।

Popular posts from this blog

The Boy, the Mole, the Fox and the Horse | Charlie Mackesy

মধ্যাহ্নভোজ | উইলিয়াম সমারসেট মম্‌ | রূপান্তরঃ তারেক নূরুল হাসান

আরেকটিবার-